রাজা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর পূর্বে দত্তনন্দীবংশীয়রা মোমেনসিং পরগনার জায়গিদার ছিলেন ঃ
ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, রুকনুদ্দীন বারবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪), সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ-এর জ্যেষ্ঠপুত্র নুসরত শাহ এবং জঙ্গলবাড়ির দেওয়ান বংশের প্রতিষ্ঠাতা ঈশা খাঁ এই মোমেনশাহী (মোমেনসিং) পরগনার অধিকারী ছিলেন। ১৬০৯ সালে ঈশা খাঁর তৃতীয় শক্তিধর খাজা উসমান খাঁ বোকাইনগর ত্যাগ করার পর অত্র পরগনার সব কিছু মুঘলদের অধীনে চলে যায়। কালক্রমে ঈশা খাঁর অনুসারী রোমান্টিক হিরু খাজা উসমান খাঁ লোহানী, মুঘল দেওয়ানগণ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে এই জমিদারি নেত্রকোণার আটপাড়া উপজেলার তেলিগাতী ইউনিয়ন অন্তর্গত মঙ্গলসিদ্ধ গ্রাম নিবাসী দত্ত বংশীয়দিগের অধিকারগত হয়েছিল। দত্ত বংশীয়েরাই কিছুদিন পরগণার অধিকারী ছিলেন। কালক্রমে কেন্দুয়ার রামপুরের নন্দী বংশীয় কোন ব্যক্তি দত্ত বংশে বিবাহ করে বিবাহের যৌতুক স্বরূপ ঐ জমিদারির ছয় আনা অংশ প্রাপ্ত হন।রাজস্ব বাকি পড়ার কারণ দেখিয়ে দত্তনন্দীদের বিশ্বস্ত আইনজীবী বা মোক্তার ভৃগুরাম দেব বাবু কিছুদিনের জন্য সময় চেয়ে নেন মুর্শিদাবাদের রাজস্ব বিভাগ থেকে। কিন্তু খাজনা পরিশোধ করা আর সম্ভব হলো না। এভাবে খাজনা বাকি পড়ে গিয়েছিল প্রায় দুই বছর ধরে। সম্পত্তির বিভাগ লইয়া কেল্লা বোকাইনগরের শাসনকর্তার নিকট ৩/৪ জন অংশীদার আবেদনও করলেন।পরিবারের সবাই একত্রিত হয়ে খাজনার অর্থ জোগাড় করেন। প্রয়োজনীয় প্রহরীসহ তা নৌকাযোগে পাঠানো হয় মুর্শিদাবাদে। কিন্তু পথেই সে অর্থ লুটে নেয় দস্যুরা।ঘটনার সত্যতার অনুসন্ধানের জন্য নবাবকে অনুরোধ করাইলেন। খাজনা লুটের খবর মুর্শিদাবাদে পৌঁছার পর নবাব ভাবতে থাকেন, তাকে ফাঁকি দিতেই লুটের নাটক সাজানো হয়েছে কিনা। তবু মোক্তার ভৃগুরাম বাবু অনেক অনুনয়-বিনয় করে একটি তদন্তের ব্যবস্থা করেন। তদন্তের দায়িত্ব পড়ে ময়মনসিংহ প্রদেশের বোকাইনগর কেল্লার অধিকর্তা মুজা বাখর ওয়াদ্দেদা সাহেবের ওপর। তদন্ত শেষে তিনি নবাবকে জানান, দত্তনন্দী বংশীয় জমিদারদের মধ্যে আত্মকলহ বিদ্যমান। স্বার্থ-চিন্তা ও গৃহ-বিবাদের অগ্নিতে দত্তনন্দী বংশীয়দের সুখশান্তি ভস্মীভূত এবং তাদের জমিদারি বাজেয়াপ্ত হয়। সিন্ধা পরগণার মুসলমান জমিদার বড়ই কর্মদক্ষ ও বিশ্বাসী। তিনি মোমেনসিং পরগণার কর আদায়ের ভার গ্রহণ করতে পারবে। কেল্লাদারের অনুরোধ ক্রমে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সিন্ধা পরগণার আদায় অনাদায়ের হিসাব দেখে উক্ত জমিদারকে অনুপযুক্ত বলে মনে করলেন; এবং একটি বিদ্রোহ দমনের পুরস্কার স্বরূপ শ্রীকৃষ্ণকে মোমেনসিং পরগণার চৌধুরী পদে প্রতিষ্ঠিত করলেন। বোকাইনগর যাওয়ার উদ্দেশ্যে শ্রীকৃষ্ণ তলাপাত্র সন্মানসূচক ‘চৌধুরী’ উপাধিতে ভূষিত হয়ে নূতন জমিদারি অভিমুখে যাত্রার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন।
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর জমিদারি সম্পত্তি চার আনা করে চার ভাগে বিভক্ত:
তরফ করৈ শেলবর্ষ পরগনা (বগুড়া), ছিন্দাবাজু পরগনা (বগুড়া), জাফরশাহী পরগনা (জামালপুর), মোমেনসিং পরগনা (পূর্ব ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ) এই চার পরগনার জমিদার ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী। গৌরীপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী বগুড়ার কড়ই রাজবাড়িতে দুই বিয়ে করেছিলেন। আদমদিঘি উপজেলার কড়ই রাজবাড়িতে তার প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানরা আগে থেকেই পৃথকভাবে বসবাস করতেন। তারা পৃথক বাড়িতে থাকলেও শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর আগে বিষয় সম্পত্তি অবিভক্ত ছিল। জমিদারির শাসন, সংরক্ষণ, তদারকি একযোগে হতো। জমিদারির দাপ্তরিক কাজও একত্রেই হতো। পরে ভ্রাতৃবিরোধ ও আত্মকলহে এই পরিবারের বন্ধন পৃথক হয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর কৃষ্ণকিশোর, কৃষ্ণগোপাল, গঙ্গানারায়ণ ও লক্ষ্মীনারায়ণ এই চার ভাই সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হন। চার ভাইয়ের মধ্যে দু’টি তরফ গঠিত হয়েছিল- প্রথম তরফ রায়চৌধুরী হিস্যা ও দ্বিতীয় তরফ চৌধুরী হিস্যা। এই সব উদাহরণ থেকে স্পষ্টই উপলদ্ধ হয় যে, শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জমিদারির ১৬ আনা বা ৩২০ গন্ডার মধ্যে কৃষ্ণগোপাল রায়চৌধুরীর অংশ হিসেবে গৌরীপুর জমিদারির চার আনা বা ৮০ গন্ডা, কৃষ্ণকিশোর রায়চৌধুরীর অংশ হিসেবে রামগোপালপুর জমিদারির চার আনা বা ৮০ গন্ডা, গঙ্গানারায়ণ চৌধুরীর অংশ হিসেবে কালীপুর জমিদারির চার আনা বা ৮০ গন্ডা এবং লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর অংশ হিসেবে বোকাইনগর জমিদারির চার আনা বা ৮০ গন্ডা হিসাব করে পৃথক হয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে যুগল কিশোরের কথা উল্লেখ করা যায়। প্রয়াত কৃষ্ণগোপালের দত্তকপুত্র জমিদার যুগলকিশোর রায় চৌধুরী জাফরশাহী পরগনা অর্থাৎ জামালপুরের কৃষ্ণপুর হতে (ইংরেজি ১৭৬৫ সাল হতে ১৭৭০ সাল পর্যন্ত) জমিদারি করে আসছিলেন। ১৭৭০ সালের মহামারী অর্থাৎ বাংলা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলে তিনি জাফরশাহী পরগনা ছেড়ে মোমেনসিং পরগণায় এসে গৌরীপুর নাম দিয়ে একটি নতুন শহর বা বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে (১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের পর) প্রথম তরফ রায়চৌধুরী হিস্যার সম্পত্তি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একাংশ গৌরীপুর রাজবাড়ি ও অপরাংশ রামগোপালপুর জমিদারবাড়ি সৃষ্টি হয়। একইভাবে দ্বিতীয় তরফ চৌধুরী হিস্যার সম্পত্তি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একাংশ কালীপুর জমিদারবাড়ি ও অপরাংশ বোকাইনগর বাসাবাড়ি জমিদারি সৃষ্টি হয়। জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে বোকাইনগর বাসাবাড়ির সংক্ষিপ্ত বিবরণের কথা উল্লেখ রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর কনিষ্ঠ ছেলে লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো- “লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরী মালঞ্চায় কিছুদিন বাস করিয়া তৎপরে পিতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বাসা বাটিতে বাস করিতে লাগিলেন, ঐ গৃহই তাহার পুত্র পৌত্রগণের কল-নিনাদে পরিপূর্ণ হইল। তিনি পিতৃ-বর্তমানেই বিষয় কার্যের ভার গ্রহণ করিয়া দক্ষতার সহিত জমিদারি শাসন সংরক্ষণ করিতে লাগিলেন।…….লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরী ভবানী দেবীর পাণিগ্রহণ করেন। তাহার শ্যামচন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্র ও রুদ্রচন্দ্র চৌধুরী নামে তিন পুত্র জন্মে। লক্ষ্মীনারায়ণের বাসাবাড়িতেই দেহত্যাগ হইয়াছিল।”