মো: এমদাদুল ইসলাম;
ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দে মুখরিত ছিল গ্রামীণ জনপদ। কিন্তু এখন ঢেঁকির সেই শব্দ আর শোনা যায় না। কাঠের ঢেঁকি এখন গ্রামীণ জনপদে বিলুপ্তপ্রায়। আগে প্রায় সবার বাড়িতেই ঢেঁকি ছিল। ঢেঁকিছাঁটা চাল ও চালের গুঁড়ার পিঠার গন্ধে মন জুড়িয়ে যেত। টেঁকি দিয়ে যে ধান ও ছিড়া হতো তার স্বাদ ও গন্ধ ছিল আলাদা যা খেতে ছিল সুস্বাদু। কিন্তু এখন আর তা নেই। ঢেঁকি সাধারণত বরই,কাাঁঠাল ও জামগাছের কাঠ দিয়ে তৈরি করা হতো। তিন থেকে চার হাত দৈর্ঘ্য, আর পৌনে এক হাত চওড়া। মাথার দিকে একটু পুরু এবং অগ্রভাগ কিছুটা মোটা। মাথায় থাকে এক হাত পরিমাণের কাঠের অগ্রভাগে লোহার পাথ নসানো থাকে । এর মাথায় লাগানো থাকে লোহার গুলা। এর মুখ যে নির্দিষ্ট স্থানে পড়ে সে স্থানকে লোড বলে। এই লোডে ভেজানো চালে পাড় দিয়ে তৈরি করা হয় গুঁড়া। আর পিষে যে চাল হতো সেটাই হলো টেঁকি ছাঁটা চাল।
আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি এখন আর চোখে পড়ে না। অথচ একসময় ঢেঁকি ছিল গ্রামীণ জনপদে চাল ও চালের গুঁড়া বা গমের আটা তৈরি করার একমাত্র মাধ্যম। সত্তরের দশকের পর ইঞ্জিনচালিত ধানভাঙা কল আমদানি শুরু হওয়ার পর গ্রামাঞ্চল থেকে ঢেঁকি বিলীন হওয়া শুরু হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত। গ্রামের মানুষ ভুলে গেছেন ঢেঁকিতে ছাঁটা চালের স্বাদ ও গন্ধকে। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতা গ্রাস করেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঢেঁকি শিল্পকে। বাঙালি জীবনাচরণের আরেকটি বড় অংশ ছিল নবান্ন উৎসব। গ্রামাঞ্চলের মানুষের ভাষ্য, গ্রামে একসময় নতুন ধান ওঠাকে কেন্দ্র করে নবান্ন উৎসব হতো। সেই উৎসবে পরিবারের শিশু-কিশোররা কত আমোদ-আহ্লাদে নাচত আর গাইত। বাঙালি জীবনের এই উৎসবটার সঙ্গেও ছিল ঢেঁকির সম্পর্ক। ঢেঁকিতে ছাঁটা চালের আটা থেকে তৈরি হতো নানা উপাদেয় রকমারি পিঠা। বাড়ি বাড়ি পিঠা তৈরি ও খওয়ার ধুম পড়ে যেত।
গ্রামবাংলার নববধূ, ও তরুন তরুণীরা নবান্ন উৎসবের জন্য বিভিন্ন ধরনের পিঠাপুলির আয়োজন করত। ঢেঁকির ঢেঁকুর-ঢুঁকুর মিষ্টি-মধুর শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মনের সুখে গান শুনতে শুনতে বৃদ্ধাদেরও চলত তাম্বল বিলাশ। আজকাল যা কেবলই মধুময় স্মৃতি। নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার বুধি গ্রামের হেলাল উদ্দিনের বাড়িতে এখনও ১টি ঢেঁকি আছে। তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, তার মা বেগম গুঁড়া তৈরি করে পোঁয়া পিঠা তৈরি করেন ধারুন স্বাদ ও গন্ধ যার তুলনা হয় না।নিজ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকার নি¤œ আয়ের লোকজন,চাল,মরিছ,হলুদ গুড়া করতে নিয়মিত টেঁকি ব্যবহার করে। বেগম জানান, সারা বছরই কম-বেশি তার এখানে চালের গুঁড়া তৈরি করতে মানুষ আসেন। বাংলাদেশের গ্রামগুলো ঘুরেও এখন ঢেঁকির দেখা মেলে না। কালের বিবর্তনে ঢেঁকি এখন শুধু ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে। দিন দিন ঢেঁকি বিলুপ্ত হলেও একে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। আগামী প্রজন্ম যাতে বাংলার এসব সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মেলবন্ধন স্থাপন করতে পারে, সেজন্য সরকারি বা বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়ার উদ্দ্যোগ নেয়া জরুরী।